বিভিন্ন ধরনের চা শনাক্তকরণ
চা এক ধরনের গাছ, এর বৈজ্ঞানিক নাম : (Camellia sinenssis)। যার পাতা এবং কুঁড়ি বা মুকুল থেকে উৎপাদিত চা পানীয় আকারে ব্যবহৃত হয়। এটি Theaceae পরিবারের ছোট বৃক্ষজাতীয় উদ্ভিদ। চা বাংলাদেশের একটি অর্থকারী ফসল ও রপ্তানি পণ্য। বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয়র মধ্যে একটি হলো চা। যত ধরনের চা আছে সবই তৈরী হয় ক্যামেলিয়া সাইনেনসিস থেকে। এই চির-হরিৎ গুল্ম বা ছোট গাছ থেকে পাতা এবং পাতার কুঁড়ি সংগ্রহ করে তা চা উৎপাদনে করা হয় । বিভিন্ন ধরনের চায়ের মধ্যকার পার্থক্য গুলো চাষের ধরন, পরিস্থিতি এবং উৎপাদন প্রক্রিয়াতে ভিন্নতা রয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন ধরনের চায়ের সাত সুঘ্রাণ, ফ্লেভার এবং রংয়ের উপর নির্ভর করে।
চা উৎপাদন প্রযুক্তির তালিকা ( list the production technologies of tea) :
১) চায়ের অনুকূল পরিবেশ।
২) জাত।
৩) বংশবিস্তার।
৪) জমি প্রস্তুতি ও রোপন পরিকল্পনা।
৫) চারা রোপন সময়।
৬) রোপণ সারি।
৭) রোপন পদ্ধতি ও রোপন দূরত্ব।
৮) ছায়া গাছ রোপন ও প্রতিপালন।
৯) সারের মাত্রা ও প্রয়োগ পদ্ধতি।
১০) সেচ ও নিষ্কাশন।
১১) চায়ের আগাছা নিয়ন্ত্রণ।
১২) মালচ প্রয়োগ।
১৩) চা পাতা সংগ্রহ।
১৪) চায়ের রোগ ও পোকামাকড়।
১৫) ফলন।
কাজের বিবরণী :-
১) কালো চা :
প্রথমে আমরা কালো চা (Black tea) এর পরিচিতি ও শনাক্তকরণ সম্পর্কে জানব। এজন্য কালো চায় পাতার নমুনা সংগ্রহ করতে হবে।
(ক) পরিচিতি : চা গাছের পাতা তুলে সেটি কে ক্রাশ, কার্ল,রোল ও টার্ন করে শুকিয়ে যাওয়ার আগে পুরোপুরি ফারমেন্টেশন বা গাঁজন প্রক্রিয়ায় অক্সিডাইট (জারণ) হয়ে কালো চা তৈরি করা হয়। পাতাগুলো পুরোপুরি অক্সিডাইট হয়ে গেলে কালো চা স্ট্রং ও ডার্ক ছেলে বারের হয় ফ্লেভারের হয়। নানান ব্রান্ডের কালো চা বিক্রি হয়। কালো চা সবচেয়ে সাধারণ ভ্যারাইটি।
(খ) কালো চা সনাক্তকরণ :
. ১০০° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পানি গরম করতে হবে।
. গরম পানিতে কালো চা পাতার গুড়া ৩-৪ মিনিট সিদ্ধ করতে হবে।
. পানি ছেঁকে স্বচ্ছ একটি কাপে নিতে হবে।
. চায়ের রঙ হবে লালচে ধরণের।
২) সবুজ চা :-
এখন আমরা সবুজ চা ( Green tea) এর পরিচিতি ও সনাক্তকরণ সম্পর্কে জানব। ভালো মানের সবুজ চা বাজার থেকে সংগ্রহ করতে হবে।
(ক) পরিচিতি : সবুজ চা তৈরি করা হয় চা পাতাকে সরাসরি শুকিয়ে গুড়ো করার মাধ্যমে। এক্ষেত্রে চা পাতার ফারমেন্টেশন করা হয় না। যে কারণে চায়ে এন্টিঅক্সিডেন্ট এর পরিমাণ খুবই কমে যায় না, যা অনেক শরীরবৃত্তীয় কাজে সহায়তা করে। তবে ফার্মেসেশন না হওয়ার কারণে ক্যাফেইনের পরিমাণ অনেকটা কম থাকে।
(খ) সবুজ চা শনাক্তকরণ :-
. এক চা চামচ গ্রীন টি নিতে হবে।
. ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পানি গরম করতে হবে।
. তারপর তা সামান্য ঠান্ডা হলে স্টিল বা কাচের পাত্রে রাখতে হবে।
. চা পাতা পুরোপুরি ভিজে গেলে স্বচ্ছ চায়ের কাপে ঢালতে হবে।
. চায়ের রঙ হবে হালকা সবুজ ধরনের।
৩. উলং চা :-
আমরা উলং চা (Wulong or oolonh tea) এর শনাক্তকরণ সম্পর্কে জেনে নেই। বাজারে বিভিন্ন ধরনের উলং চাপাতা পাওয়া যায়। যেকোনো একটি ভালো নমুনা সংগ্রহ করতে হবে।
(ক) পরিচিতি : উলং চা অর্ধেক গার্জন প্রস্তুত করা হয়। অর্থাৎ প্রস্তুত ভিত্তিতে কালো চা আর সবুজ চায়ের মাঝখানে এর অবস্থান। সবুজ চায়ের মত এর আছে বহুমুখী গুন। উলং চা বাংলাদেশে পাওয়া যায় তবে কিছুটা অপ্রতুল এবং দামেও বেশি।
(খ) উলং চা শনাক্তকরণ :
. কেটলিতে চা পাতা ও পানি নিয়ে ২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সিদ্ধ করতে হবে।
. ৩ গ্রাম চা পাতার জন্য ২০০ মিলি পানি নিন।
. সিদ্ধ করা চা পাতাগুলো ৫ থেকে ৮ মিনিট রেখে দিন।
. তারপর স্বচ্ছ চায়ের কাপে ছেঁকে নিন।
. উলং চা একই পাতা থেকে ২-৩ বার চা তৈরি করা যায়।
. পাতা সিদ্ধ করার ভিত্তিতে হালকা হলুদ, সবুজ , লাল ও গারো রং হতে পারে।
৪) সাদা চা :
এবার আমরা সাদা চা (white tea) এর পরিচিতি ও শনাক্তকরণ সম্পর্কে জানব। বাজার থেকে উন্নত মানের সাদা চায়ের পাতা সংগ্রহ করতে হবে।
(ক) পরিচিতি :- চা গাছে যে কুঁড়ি এখনো প্রস্ফুটিত হয় নি। সেই বন্ধ কুঁড়িগুলোর একটা একটা করে চা গাছ থেকে তুলে প্রক্রিয়াজাতকরণের পর এই বিশেষ চা তৈরি হয়ে থাকে। সব চায়ের মধ্যে সাদা চা হলো সবচেয়ে কম প্রক্রিয়াজাত করা। এই চায়ের পিতু হলুদ বা পুতুলের মত হলুদ। এর মূল রংটা হলো সবুজ ও হলুদ রঙের মাঝামাঝি। একে ওয়াইটি বলার কারণ হলো এর গায়ে সাদা লোম রয়েছে। এই চাকে কেউ বলে থাকেন সিলভার নিউল হোয়াইট টি (silver needle white tea) বা রুপার সুঁই মতো সাদা চা। এই চায়ে পাতা উত্তোলনে নেওয়া হয় কঠিন মান নিয়ন্ত্রণ। পাতায় কোন প্রকার পানি থাকতে পারবে না হোয়াই টি মানব দেহের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
(খ) সাদা চা সনাক্তকরণ :-
. প্রথমে পরিমাণ মতো পানি কেটলিতে নিয়ে গরম করতে হবে।
. গরম পানিতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সেই পানি একটি কাপের ঢালতে হবে।
. তারপরের মধ্যে এক টেবিল চামচ পরিমাণ হোয়াইট টি দিয়ে পাঁচ মিনিট রেখে দিতে হবে।
. পাঁচ মিনিট পর রাখলেই তৈরি হয়ে যাবে অনন্ত উপকারী সাদা টি।
৫) হারবাল চা :-
এখন আমরা জানবো হারবাল টি (herbal tea) বা ভেষজ চায়ের পরিচিত ও শনাক্তকরণ সম্পর্কে। বাজারে বিভিন্ন হারবাল চা পাতা পাওয়া যেকোনো একটি নমুনা সংগ্রহ করতে হবে।
(ক) পরিচিতি : হারবাল টি সাধারণত বিভিন্ন ধরনের ফল, ফুল, মসলা বা হার্বস হতে তৈরি করা হয়। এ যাতে বিভিন্ন ধরনের ঘ্রাণ পাওয়া যায়। বিভিন্ন নামে যা পাওয়া যায় ক্যামোমিল চা, হিবিস্কাস বা জবা ফুলের চা, মেন্হল চা, হলুদ চা, পুদিনা চা, আদা চা ইত্যাদি।
(খ) হারবাল চা শনাক্তকরণ :-
. কেটলিতে পানি ও হারবাল চা পাতা দিয়ে ১৫ মিনিট সিদ্ধ করতে হবে।
. তারপর চুলা থেকে সরিয়ে ৫ মিনিট ঢেলে রেখে দিতে হবে।
. তারপর থেকে নিয়ে চায়ের কাপে ঢালতে হবে।
. উৎপাদনের ভিত্তিতে হারবাল চায়ের রং বিভিন্ন ধরনের হতে পারে।
৬) হলুদ চা :
এবার আমরা ইয়েলো কি (yellow tea) বা হলুদ চাষ সম্পর্কে জানব। বাজার থেকে উন্নত মানের ইয়েলো টি কামনা সংগ্রহ করতে হবে।
(ক) পরিচিতি : ইয়েলো কি উইদারিং বা নির্জী করা হয় না। উজ্জ্বল হলুদ রঙের জন্য ইয়োলো টি নামে খ্যাত চা। বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোক দিয়ে এই চা এর পাতা বাগান থেকে তুলতে হয় এবং একটা একটা করে করি নির্বাচন করতে হয়। তবে এই হলুদ ভাবে আসে না। চা-পাতা কে সিলড ইয়েলোইং (Sealed yellowing) নামে এক বিশেষ প্রক্রিয়া জাত-করণের মাধ্যমে এই হলুদ রঙ আনা হয়। গুনাগুনের দিক দিয়ে প্রায় এর মতন আলাদা এই হলুদ চায়ের।
(খ) ইয়েলো টি সনাক্তকরণ :-
. একটি পাত্রে বা কেটলিতে পরিমাপ মতো পানি নিয়ে গরম করে নিতে হবে।
. তারপর এই গরম পানিতে ইয়েলো টিয়ের পাতা দিতে হবে
. পাঁচ মিনিট ভিজিয়ে রাখতে হবে।
. তারপর থেকে চায়ের কাপে নিলে হলুদ রং পাওয়া যায়। এটাই ইয়েলো টি।
৭) রেড টি :-
সবচেয়ে আমরা রেটটি ( red tea) বা রুইবস rooibos টি সম্পর্কে। রেড টি এর নমুনা সংগ্রহ করতে হবে।
(ক) পরিচিতি :
রেটটি একটি লাল ভেষজ চা, যা আফ্রিকান রেড হিসেবে পরিচিত। রইবস চা, কেপ অফ গুড হোপ এর স্থানীয় একটি গুল্ম জাতীয় গাছ অ্যাস্প্যালাথাস লিনিয়ারিস Aspalathes linearis এর পাতা থেকে তৈরি হয়। এই পাতাটি দক্ষিণ আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলে পাওয়া যায়। পাতাটি নো' অবস্থায় অনেকটা সুচের মতো দেখতে হয়। এই চা লাল হিসেবে পরিচিত। মধু বা ভ্যানিলার মতো হালকা সুগন্ধ পাওয়া যায় এই চায়ে। মতে গ্রিন টি এর চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি এন্টি অক্সিডেন্ট রয়েছে রুইবস চায়ে, যা দেহের ফ্রি রেডিক্যালগুলোর গতি প্রতিরোধ করে এবং জারণ চাপকে রাস করে।
(খ) রেড টি সনাক্তকরণ :
. দুই কাপ ফুটন্ত গরম পানির সঙ্গে এক চা চামচ রেডটি পাতা যোগ করতে হয়।
. তারপর পাঁচ মিনিটের জন্য ঢাকনা দিয়ে রাখতে হবে।
. এরপর ছেঁকে চায়ের কাপে নিতে হবে।
. চায়ের রঙ হবে লাল।
চায়ের অর্থনৈতিক গুরুত্ব ( Economic importance of tea) :
চা বাংলাদেশের দ্বিতীয় রপ্তানি তুমি কি ফসল। এই শিল্পে বাংলাদেশের মোট দেশ উৎপাদনের এক শতাংশ আসে। বাংলাদেশের চা অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিও প্রতিবছর ৫ মিলিয়ন কেজি চা রপ্তানি হয়ে থাকে। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও প্রণয়নে নগরায়ন এর ফলে এবং জনতার শহর বিমুখতার কারণে চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেড়েছে। বিগত তিন দশকে চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেড়েছে ব্যাপক। জাতীয় অর্থনীতিতে চা শিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম ও শুরু প্রসারী। জিজিপিতে এই খেতে অবদান ০.৮১ শতাংশ। বাংলাদেশ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী ২০০১ সালে উৎপাদনে পরিমাণ ছিল পাঁচ কোটি নাগ পঞ্চাশ হাজার কেজি। ২০২১ সালে ৯ কোটি ৬৫ লাখ চা উৎপাদন করেছে বাংলাদেশ। ২০২৫ সালের মধ্যে সাড়ে ১২ কোটি কেজি চা লক্ষ মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেশের সাতটি জেলায় এক লাখ চা বাবদ করা হবে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে দেশের চাহিদা পূরণ করে বিপুল পরিমাণে উন্নতমানের চা রপ্তানি করা সম্ভব। চায়ের পাতা কাণ্ড এবং জলীয় দ্রবণ এবং সৌন্দর্য সামগ্রীতে ব্যবহৃত হয়।
কমেন্ট করুন;
comment url